৪ মে,২০২০
জীবন জীবিকা রক্ষায় দেশজুড়ে হবে প্রতিবাদ, আহ্বান পলিট ব্যুরোর।
দেশের বিপুল অংশের মানুষ ক্ষুধায় ভুগছেন, জীবিকার সংস্থান হারিয়েছেন, অন্তত ১৫ কোটি নতুন করে বেকার হয়ে পড়েছেন। একতরফা লকডাউন ঘোষণা করলেও মহামারী মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়নি। দেশের মানুষের জীবন জীবিকার সহায়তার বদলে কর্পোরেটদের মুনাফার সুযোগ প্রসারিত করা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ধ্বংস করা হচ্ছে। সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশব্যাপী এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করা হবে। ১৬ জুন সর্বভারতীয় প্রতিবাদ দিবস পালিত হবে।
২জুন পলিট ব্যুরোর বৈঠক হয় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। সেই বৈঠক থেকেই জনগণের জীবন জীবিকা রক্ষায় প্রতিবাদ ধ্বনিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পলিট ব্যুরো বলেছে, কেরালায় যেভাবে কোভিড-১৯ মহামারীর মোকাবিলা করা হয়েছে তা উদাহরণযোগ্য। কেরালার জনগণ ও বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে পলিট ব্যুরো বলেছে, সংক্রমণের বৃদ্ধি আটকে দিয়ে এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জোর দিয়েছে কেরালা কেননা বিদেশ এবং দেশের নানা প্রান্ত থেকে রাজ্যে মানুষ ফিরছেন। ‘কেরালা মডেল’ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা থেকে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও শিক্ষা নেয়নি।
বরং মোদী সরকার এখন কার্যত মহামারী মোকাবিলা জনগণের নিজের দায়িত্বে ছেড়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী অপরিকল্পিত, একতরফা, আকস্মিক লকডাউন ঘোষণার পরে ৬৩ দিনের এই সময়কে চিকিৎসা কাঠামো শক্তিশালী করার জন্যও ব্যবহার করেননি, যাঁরা এই হঠাৎ লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের জন্য কোনও রিলিফেরও ব্যবস্থা করেননি। একতরফা লকডাউন ঘোষণার পরে এখন কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের বাড়ি ফেরার মানবিক বিপর্যয়কে রাজ্য সরকারগুলির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রীর নামে বেসরকারি ট্রাস্টে সংগৃহীত হাজার হাজার কোটির অর্থ তিনি রাজ্যগুলিকে দিচ্ছেন না।
বিধিনিষেধ শিথিল করাও হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। কেন্দ্রীয় সরকার দায়িত্ব পরিহার করে রাজ্য সরকারগুলির ওপরে তা ছেড়ে দিচ্ছে। লকডাউনের সময়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু একটানাই বেড়েছে। ২৪ মার্চ ভারতে পজিটিভ ছিল ৫৬৪, মৃত্যু ছিল ১০। এখন তা ২লক্ষ ৭ হাজার ও ৫৮১৫।
পলিট ব্যুরো বলেছে, লকডাউনের সময়ে উচিত ছিল মহামারী মোকাবিলা ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে রিলিফ দেওয়ার কাজে পূর্ণ মনঃসংযোগ করা। তার বদলে কেন্দ্রীয় সরকার আগ্রাসীভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও নয়া উদারনীতি রূপায়ণে মত্ত থেকেছে। মুসলিম সংখ্যালঘুদের হয়রানি করা হয়েছে, সিএএ-এনআরসি বিরোধী প্রতিবাদ অংশগ্রহণকারীদের স্বেচ্ছাচারীভাবে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়েছে, রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইন, ইউএপিএ, এনএসএ প্রয়োগ করে প্রতিবাদের সমস্ত কণ্ঠস্বরকে দমন করা হয়েছে। সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে খর্ব করে এই সময়ে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে।
পলিট ব্যুরো বলেছে, ১ জুন কেন্দ্রীয় সরকার কিছু আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। পূর্বঘোষিত ২০লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের মতো এও পুরানো প্রকল্পকে নতুন মোড়কে হাজির করা। জিডিপি-র মাত্র ১ শতাংশ বাড়তি বরাদ্দ করা হয়েছে। এই প্যাকেজ মূলত ঋণের, সরকারি বরাদ্দ নয়। এই প্যাকেজ নয়া উদারনীতির পথে সংস্কারের নকশা, দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের মুনাফা বাড়ানোর রাস্তা করে দিয়েছে, সমস্ত জাতীয় সম্পদ বেসরকারিকরণ করার চেষ্টা হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, সমস্ত ক্ষেত্রকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মোচিত করে দেওয়া হয়েছে। শ্রম আইনের ওপরে ভয়ানক আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। অন্তত দশ রাজ্যে লকডাউনের অজুহাতে শ্রম আইন নস্যাৎ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিরোধ করা হবে।
পলিট ব্যুরো বলেছে, ১জুন বহু বাগাড়ম্বর করে সরকার যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করেছে তাতে বৃদ্ধির হার ধানের ক্ষেত্রে মাত্র ২শতাংশ, বাকি শস্যেরও প্রায় তাই। গত এক বছরে উৎপাদনের ব্যয় যতটা বেড়েছে এই বৃদ্ধি তার থেকে কম। কৃষককে আরও ঋণগ্রস্ততায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের দরকার রিলিফ, তার বদলে ঋণের ঘোষণা করা হয়েছে। দেখা গেছে, আরবিআই আগে যে ঋণের কথা বলেছিল তা কেউ নেয়নি। সেই টাকা আরবিআই-এ ফেরত এসেছিল। এর অর্থ হলো মানুষের যদি ক্রয়ক্ষমতা না থাকে, তাহলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হবে না। অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হবে না। সরাসরি সহায়তা না করলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না। এই সত্য উপেক্ষা করেই চলেছে মোদী সরকার।
পলিট ব্যুরো বলেছে, মহামারীর আগেই দেশের অর্থনীতি অধোগতিতে চলে গিয়েছিল। ২০১৯-২০সালের জিডিপি বৃদ্ধির হার এগারো বছরে সবচেয়ে কম। জানুয়ারি-মার্চে তা ৩.১ শতাংশে নেমে গেছে। এর থেকেও কম হবে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানের হিসাব। লকডাউনের আগেই এই অবস্থা ছিল। মহামারী ও লকডাউন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বড় অংশকে বিপর্যস্ত করেছে। দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনমানকে তা ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
রাজ্যগুলির আর্থিক অবস্থা এমনিতেই ভালো নয়। কেন্দ্রের রাজস্ব ঘাটতিতে তা আরও খারাপ হবে। রাজ্যগুলির প্রাপ্য জিএসটি ক্ষতিপূরণ এখনও দেওয়া হয়নি। মহামারী মোকাবিলায় সব রাজ্যই আর্থিক সহায়তা চাইছে। কিন্তু কেন্দ্র এখনও রাজ্যগুলিকে অর্থ দেয়নি যদিও তারাই মহামারী মোকাবিলার মূল কাজ করছে।
পলিট ব্যুরো বলেছে, গত দু’মাসের বেশি সময় দেখিয়ে দিচ্ছে দেশের সরকারি স্বাস্থ্য কাঠামোয় ঘাটতি কতটা। সবকিছূকেই বেসরকারি করতে গিয়ে মোদী সরকার কার্যত সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। অন্তত এখন জিডিপি’র তিন শতাংশ সরকারি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করতে হবে।
পলিট ব্যুরো বলেছে, লকডাউনের সুযোগে সংসদে অনুমোদিত না হওয়া একটি পশ্চাদমুখী শিক্ষানীতি চাপিয়ে দিতে চাইছে কেন্দ্র। ডিজিটাল শিক্ষা চাপিয়ে দিতে চাইছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপরে ডিজিটাল বিভাজন চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। স্কুল-কলেজের চিরায়ত পড়াশোনার পদ্ধতির বিকল্পে ডিজিটাল মাধ্যম প্রয়োগ করা চলে না। মহামারীর সময়ে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে যাতে শিক্ষাবর্ষ নষ্ট না হয়। কিন্তু তা বিকল্প হতে পারে না। যেখানে সব ছাত্রের ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ আছে কেবলমাত্র সেখানে এখন তা ব্যবহার করা যেতে পারে। ছাত্রদের যাতে শিক্ষাবর্ষ নষ্ট না হয় এবং তারা যাতে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিতে পারে, সেই লক্ষ্যে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে শিক্ষাবর্ষ পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে।
পলিট ব্যুরো উল্লেখ করেছে, সব রাজ্যে সিপিআই (এম) জনগণকে রিলিফ দেবার কাজ করেছে। লকডাউনের সময়ে যাঁদের কাজ খোয়া গেছে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে, ক্ষুধার্তদের খাবার দিয়েছে। এই কাজ চালিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়েছে পলিট ব্যুরো। বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে পলিট ব্যুরো আহ্বান জানিয়েছে।
পলিট ব্যুরো বলেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তত অতিরিক্ত ১৫কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সামগ্রিকভাবে বেকারের বিরাট সংখ্যায় তা যুক্ত হচ্ছে। বিরাট অংশের মানুষ জীবিকার সমস্ত সংস্থান হারিয়েছেন। ক্ষুধার্ত পরিযায়ী শ্রমিকের স্রোতের হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিয়েছে দেশের উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষ গভীর ক্ষুধায় কীভাবে ডুবে গেছেন। পলিট ব্যুরো সিদ্ধান্ত করেছে এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ সংগঠিত করতে হবে। বিধিনেষেধ মেনে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই এই প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। ১৬ জুন সর্বভারতীয় প্রতিবাদ দিবস পালিত হবে। দাবি জানাতে হবে:
১) আয়কর দেন না এমন সমস্ত পরিবারকে ছ’মাস মাসিক ৭৫০০ টাকা নগদে দিতে হবে;
২) ছ’মাস মাথাপিছু ১০ কেজি খাদ্যশস্য বিনামূল্যে দিতে হবে;
৩) রেগায় বর্ধিত মজুরি সহ অন্তত ২০০ দিনের কাজ দিতে হবে, শহরের গরিবদের মধ্যে কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প প্রসারিত করতে হবে, অবিলম্বে বেকার ভাতা ঘোষণা করতে হবে;
৪) জাতীয় সম্পদের লুঠ, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ, শ্রম আইন বাতিল করা বন্ধ করতে হবে।
পলিট ব্যুরো জানিয়েছে, জুলাই মাসে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেই কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হবে।
